Monday, January 29, 2024

হাঁসি

 




“গরীব মানুষের আবার হাসি কি শুনি? গরীবদের কখনো হাসতে নেই। তাদের জীবনে শুধু কান্না, কষ্ট। রক্ত জল করে দেওয়া। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চিরকাল খেটে সামান্য পেট চালানো। সত্যি, ভগবান এই হতভাগা পেটটা কেন দিলেন!” খুব হতাশ হয়ে ছোট্ট মেয়েকে বলছিল দরিদ্র রমেশ।

মেয়ে সব শোনে আর বাবাকে দেখে বাবা কাঁদছে। মেয়ে বাবা কে জড়িয়ে ধরে বলে, “বাবা পৃথিবীতে আমরা সবাই গরীব কেন জানো, কারণ আমরা প্রত্যেকেই কারোর না কারোর অধীনেই চাকরগিরি করছি। কেউ মুষ্টিমেয় চাকর কেউ আবার দরিদ্র চাকর। কিন্তু চাকর আমরা সকলেই। আর গরীব এইজন্যই যে আমরা কেউই নিজের অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি না। আমরা সবাই যতই পাই না কেন তবুও অভাববোধ কখনো কমতেই চায় না। হতদরিদ্র মানুষ যার কিচ্ছু নেই তার ক্ষেত্রেও একই কথা। তার কাছে “কিচ্ছু নেই ” এই কথাটা ভুল। সব মানুষের কাছে কিছু থাকুক বা না থাকুক, হাসি টা আছে।”

short stories in bengali
short stories in bengali বাংলা গল্প

“যেই হাসিটা মনে শান্তি দেবে, মনকে বোঝাবে যে তুমি কেবল একজনের অধীনেই চাকরগিরি করছ আর সেই একজনের কাছেই শক্তি চাও যিনি তোমাকে চাকর থেকে মন্ত্রী করতে পারে। এই হাসিটাই বোঝাবে তোমাকে যে তুমি জন্মেই গরীব ছিলে কিন্তু মৃত্যুর সময় গরীব থাকবে না, তোমার নিজের অবস্থা তোমার নিজের জন্যই পাল্টাবে। হাসো বাবা, মনে আনন্দ রাখো, সে যে পরিস্থিতিই হোক। সমস্যা , দুঃখ কষ্ট তো আসবেই। কিন্তু সমস্যায় , দুঃখে কষ্টে ভেঙে না গিয়ে সমাধান খোঁজো বাবা। হাসো বাবা, হাসি জীবনের জন্য খুব দরকার। হাসতে হবে।”

Sunday, January 28, 2024

টিফিন বক্স

 সেরা ছোট গল্প



স্কুল কলেজে টিফিন বক্সের খাবার ভাগ করে খাওয়া কমন ব্যাপার। এটা আমার মত নীরস শুকনো লঙ্কার মতো মানুষের জীবনে ও এসেছে। কিন্তু টিফিন বক্স নিয়ে প্রেম, ভেজ সুপের মতো জীবনে গোলমরিচ মতো একটা স্বাদ এনে দিয়েছিল।

মোটামুটিভাবে ওয়ান লাইনার বা শর্টকাটে যদি গল্পটা বলি তবে শুরু করি এভাবেই, আমি সকলের কাছে পরিচিত চারু বলেই। ছাত্র রাজনীতির দৌলতে নামটা পাওয়া। কলেজে উঠে পাখা সবার গজায়, আমার একটু বড় সর গজিয়ে ছিল। আসলে তার অহংকারী হওয়ার কারণ একটাই ছিল। বাবা মায়ের টাকায় আমি পড়ালেখা করতাম না। টিউশনি পড়িয়ে কলেজ করতাম। আর দুই বছর একটু চেষ্টা করে শহরের এক নম্বর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সুযোগ পেয়ে গেলাম। তাই পা তখন থেকে অহংকারে মাটিতে পরছে না।

পুরাতন কলেজে তখনও যাতায়াত বন্ধ করি নি। ইউনিয়ন রুম টা আমার দখলে। সবাই আমাকে একটু সম্মান করে, অথচ শ্রাবন্তী বেহেন জি টাইপের মেয়ে হয়েও আমাকে পাত্তাই দেয় না। এমন ভাব করে যেন চেনেই না আমাকে। মনে মনে ভীষণ অপমানিত বোধ হয় আমার।

শাস্তি দিতে হবে, মেয়ে আবার শুনেছি পড়াশোনায় ভালো, তাই রিগিং করা যাবে না। তাই আক্রমণ বা টার্গেট করা হল টিফিন বক্স। চুরি করে ওর টিফিন খেয়ে নেওয়া হলো। তিন দিন লক্ষ্য করলাম, ও চিফ ক্যান্টিনে এসে খাবার দাবারের দাম জিজ্ঞেস করে আর পরে চা বিস্কুট খেয়ে চলে যায়। আর বাড়িতে দেরিতে ঢুকছে।

তৃতীয় দিন ইউনিয়ন রুমে ডাকা হলো ওকে। জিজ্ঞেস করা হলো। কেন ও টিফিন খায় না ক্যান্টিনে।
উত্তরে জানালো, এমন রসিকতা নাকি আমাদের মতো, নির্বোধ ছেলেমেয়েদের ছেলেমানুষি তেই সাজে। সে ‘অন্য আশ্রিতা’ তাই তাকে অনেক বেশি হিসাবে করেই চলতে হয়। একটু সরাসরি আমাকে লক্ষ্য করেই বললো, “যার প্রশ্রয়ে এই কাজ টি করা হয়েছে। সে নাকি ওসব বুঝতে পারবে না। কারণ সোনার চামচ মুখে দিয়ে সে মানুষ হয়েছে”

ওর এক বান্ধবীর কথাগুলো গায়ে লাগলে, একটু প্রতিবাদ করে বললো, ” তোর টিফিন খাওয়ার কোন ইচ্ছা আমাদের নেই, আনিস তো ঐ আলুভাজা, আর তিনটা রুটি। চারু দা শুধু খেয়েছে ওগুলো জানি না কীভাবে।”

সত্যি একটা টিফিন বক্স মানুষের অর্থনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করে দেয়। হয়ত একটা সময় তাই আমি স্কুলে টিফিন নিয়ে যেতে লজ্জা পেতাম। আজ বাবা চাকুরি পেতে সব কিছু বদলে গেছে। যদিও আমি কোনোদিন অত বেশি কষ্ট পাইনি। তবে ওর উত্তরের অপেক্ষা করছিলাম। ও আমার বাড়িতে থাকে তাই আমার নাড়ি-নক্ষত্র জানে। কিন্তু ও যে হঠাৎ করেই ‘হাঁড়ি ভেঙে’ দেবে ভাবতে পারি নি।

ও বললো “যে মানুষটি ডিম পোঁচ করতে গিয়ে, ডিম পুড়িয়ে ফেলে , সে বোধহয় রুটি করতে গেলে, অস্ট্রেলিয়া কিংবা শ্রীলঙ্কার ম্যাপ বানাবেন, এবং সে গুলিকে রুটি না বলে পাঁপড় বলা যাবে। তাই আমার খাবার গুলো তার কাছে অখাদ্য হবে না আশা করি।আমরা জন্মাই সবাই উলঙ্গ ভাবেই, ঐতিহাসিক কোন সময়ের ষড়যন্ত্রের ফলে তোদের টিফিন বক্সে, নুডলস, পাস্তা, আর আমার বাক্সে শুকনো রুটি, কখনো পিঁয়াজ পান্তা, ও নিয়ে আমার লজ্জা নেই। কারণ পৃথিবীতে একদিন বড়লোক গরীব লোক ছিল না। এটা তৈরি করা হয়েছে।”

সেরা ছোট গল্প

ইউনিয়ন রুমের সবাই চুপচাপ হয়ে গেলেও, আমি চুপচাপ থাকার পাত্র নয়। পরের দিন নিজে টিফিন বক্স চুরি করে টিফিন খেয়ে একটি চিরকুট রেখে এলাম। তাতে কী লেখা ছিল?

লেখা ছিল যে, ” ভাড়া নিতে কাল আপনার ঘরে গিয়ে ছিলাম। আপনার হাতের তালের বরা খেলাম। দিদি কাল আপনার সেলাইয়ের কাজ দেখালো। একটা আসনে আপনি লিখেছেন ‘ক্ষমা পরম ধর্ম’। খুব খিদে পেয়েছিলো তাই আপনার টিফিন খেয়ে নিয়েছি। আপনার টিফিন পিরিয়ডের পরের ক্লাস বাংলা, তাই ওটাতে উপস্থিত থাকতে হবে না।

ম্যাডাম তো আপনাকে খুব স্নেহ করে। ম্যাডামই বলেছিলেন, আপনার বই কেনার পয়সা নেই কিছু একটা ব্যবস্থা করো। তাই আপনাকে ন্যাশানাল ল্যাইব্রেরীতে কার্ড করতে নিয়ে যাবো আমি। কারণ কলেজের লাইব্রেরিতে ইংরেজি সাহিত্যের বই তেমন নেই। তাই উনি উপস্থিতি দিয়ে দেবেন। বাকি আপনার ওপর। দেখা যাবে ক্ষমা করেন কিনা আপনি। টিফিন টা আপনি আমার সাথে করেন কিনা! বাস স্ট্যান্ড আমি অপেক্ষায় থাকবো।”

এরপর কি হয়েছিল জানতে চাইছেন? আমার টিফিন বক্সে এখন ফুটবলের মতো গোল রুটি থাকে, সাথে ফ্রেন্চ ফ্রাই এর মতো আলু ভাজা, তাও আমার নিজের হাতে বানানো। বাকি আপানারা বুঝে নিবেন।

মেঠো ইদুর ও শহুরে ইদুর

 

একদিন এক গণ্যমান্য শহুরে ইদুর গেল এক গ্রামের মেঠো ইদুরের কাছে। মেঠো ইদুর বাস করত  মাঠের এক গর্তে। সে তার শহুরে অতিথিকে মটর ও গমের দানা খেতে দিল।

গণ্যমান্য ইদুর একটু খুঁটে খেয়ে বলল, “তোমার খাবার খুবই অপুষ্টিকর তাই তুমি এমন রোগা। তুমি একদিন এসো আমার কাছে, দেখো আমরা কীভাবে থাকি।”

তখন মেঠো ইদুর গেল শহুরে ইদুরের কাছে। সে থাকত এক বাসার মেঝের নিচে গর্তে। রাতের জন্য তারা দুজন মেঝের নিচে অপেক্ষা করল। রাতে লোকেরা এসে খেয়ে চলে গেল। তখন শহুরে ইদুর তার অতিথিকে এক গর্ত দিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে গেল। তারা দুজনেই চড়ে বসল টেবিলের উপর। সাধারণ মেঠো ইদুর জীবনে কখনও এমন ভালো খাবার চোখেও দেখেনি।

সে বলল, “তুমি ঠিক বলেছ, আমাদের জীবন খুবই খারাপ। আমিও শহরে বাস করতে চলে আসব।”

একথা বলতে না বলতেই টেবিল কেঁপে উঠল। আর দরজা দিয়ে মোমবাতি হাতে নিয়ে তাদের ধরতে লোক ঘরে ঢুকল। তখন তারা কোনো রকম গর্তে ঢুকে নিজেদের প্রাণ বাঁচাল।

মেঠো ইদুর বলল, “না!, এর চেয়ে আমার মাঠে বাস করা অনেক ভালো। সেখানে এমন মিষ্টি খাবার নেই ঠিকই, তবে এমন ভয়ের কোনো কারণও নেই।”

গল্পের শিক্ষা: যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সুখে থাকা ভালো।

দাঁড়কাক




 সে অনেক অনেকদিন আগেকার কথা। এক দেশে ছিল এক রানি আর রানির ছিল একটা ছোট্ট মেয়ে। সে এতটাই ছোট ছিল যে তাকে সবসময় কোলে কোলে নিয়ে রানিকে ঘুরে বেড়াতে হত। কারন সে যে খুব ছোট্ট ছিল আর রোগাও ছিল। তবে ছোট্ট হলে হবে কি মেয়েটা ছিল ভীষন ছটফটে আর দুষ্টু। তাকে খাওয়াতে ঘুম পাড়াতে আর তার কান্না থামাতে রানির ঝামেলার অন্ত নেই। একদিন রানি এমনি করেই কোলে করে মেয়েকে নিয়ে তার দুষ্টুমি থামানোর জন্য রাজমহলের বারান্দায় পায়চারি করছেন কিন্তু মেয়েতো কিছুতেই কথা শোনেনা, কান্না থামায় না। রাজমহলের পাশ দিয়ে তখন উড়ে যাচ্ছিল অনেকগুলো দাঁড়কাক আর রানি তো তখন মেয়ের দুষ্টুমিতে রেগে আগুন, তাই জানলা খুলেই দাঁড়কাকের দিকে তাকিয়ে মেয়েকে বলল তুই যেন এমনি দাঁড়কাক হয়ে উড়ে যাস অনেক দূরে তাহলেই আমি খানিকক্ষন বিশ্রাম পাব। কিন্তু রানির মুখের কথা শেষ হতে না হতেই তার মাথার ওপর ঝটপট শব্দ করে মেয়েটা দাঁড়কাক হয়ে উড়ে গেল অনেক অনেক দূরে এক অন্ধকার বনের ভেতর। সেদিন থেকে রানির মেয়ের আর কোন খবর নেই- সে দাঁড়কাক হয়েই রইল আর রানির বুকে জমে রইল দুঃখের পাহাড়।


তারপর অনেকদিন পর একজন লোক সেই অন্ধকার বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেল দূরে কোথাও একটা দাঁড়কাক কাঁদছে। কাকের কান্নার শব্দ অনুসরন করে করে লোকটা দাঁড়কাকের কাছে পৌঁছতেই, দাঁড়কাক বলে উঠল


বন্ধু, আমাকে তুমি সাহায্য কর। আমি এক রানির মেয়ে, কিন্তু এখানে জাদুবলে আমি বহুদিন দাঁড়কাক হয়ে আছি;

তুমি আমাকে উদ্ধার করে সাহায্য করবে?




এই কথা শুনেই লোকটা জিজ্ঞেস করল সে কিভাবে তাকে এই জাদুরুপ থেকে আবার পুরোনো রুপে যেতে সাহায্য করতে পারে?


দাঁড়কাক বলল, বন্ধু শোনো, তোমাকে কি করতে হবে- এখান থেকে আরও কিছু দূর গভীর বনের দিকে গেলেই তুমি দেখতে পাবে একটা পুরোনো বাড়ী, সেখানে এক বুড়ি বসে রয়েছে- সে তোমাকে খাবার আর জল দেবার জন্য ডাকবে, কিন্তু তুমি ওইসব খবরদার ছুঁওনা কারন তাহলেই তুমি ঘুমিয়ে পড়বে আর আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। বাড়ীর পেছনে যে বাগান আছে সেখানে দেখবে চামড়ার বিশাল এক স্তুপ, সেখানেই তুমি আমার জন্য অপেক্ষা কোরো। আগামী তিন দিন ধরে প্রতি দুপুরেই ঠিক দুটোর সময় আমি ঘোড়া গাড়ী করে আসব সেখানেই।প্রথম দিন আমি সাদা ঘোড়া করে, দ্বিতীয় দিন খয়েরী ঘোড়া করে আর শেষের দিন আমি আসব কালো রঙের ঘোড়া টানা গাড়ি করে। তুমি ঘুমিয়ে পড়লে কিন্তু আমি মুক্ত হতে পারব না। এই কথা শুনে লোকটা দাঁড়কাককে আশ্বস্ত করল যে, সে ঘুমিয়ে পড়বে না, আর দাঁড়কাকও মানে রানির সেই মেয়ে আরও একবার তাকে মনে করিয়ে দিল যে সেই বুড়ির কাছ থেকে সে যেন জল খাবার কিচ্ছুটি না খায় কারন বুড়ির হাত থেকে কিছু খেলেই সে ঘুমিয়ে পড়বে।


দাঁড়কাকের কথা শুনে লোকটা এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে; গিয়ে দেখল ঠিক যেমনটি বলেছিল দাঁড়কাল ঠিক তেমনই এক বুড়ি বসে রয়েছে বাড়ীর দাওয়ায়। দেখা মাত্রই বুড়ি তার কাছে এগিয়ে এল , তাকে দেখেই বলল তুমিতো বাবা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছো, অনেক দূর থেকে আসছ বুঝি? এসো কিছু খাবার আর জল খেয়ে একটু জিরিয়ে নাও। কিন্তু লোকটা তো দাঁড়কাককে কথা দিয়েছে তাই সাথে সাথেই সে না বলে দিল। কিন্তু বুড়িও তো নাছোড়বান্দা, তাই তাকে বলল খাবার না খাও এক গ্লাস জল অনন্ত খাও বাবা, তাহলে কিছুটা হলেও একটু স্বস্তি পাবে। লোকটাও এতোটা দূরে হেঁটে আসার ফলে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, দাঁড়কাকের কথা ভুলে গিয়ে সেও জল খেয়ে নিল। দুপুর দুটোর কিছু আগেই দাঁড়কাকের কথা মতো সে বাড়ীর পেছনের বাগানে যেখানে চামড়ার বিশাল স্তুপ ছিল সেখানে হাজির হল আর দাঁড়কাকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু, কিছুক্ষন পরেই লোকটার চোখ লাল হতে হতে ঘুমে ঢলে এল, সে নিজেকে হাজার চেষ্টা করল চোখ বড় করে করে জেগে থাকার কিন্তু কোন কিছুই কাজে লাগল না। কিছুক্ষনের মধ্যেই সে এমন ঘুমে চলে গেল যে বাইরের কোন শব্দই আর তার কানে গিয়ে পৌঁছনার মতো অবস্থা রইল না।


এদিকে দাঁড়কাক তো ঠিক দুটোতে তার কথা মতো সাদা ঘোড়া টানা গাড়িতে করে এসে হাজির। এসেই ঠিক যা ভেবেছিল, তাই দেখে ভীষন দুঃখ পেল, বারে বারে বলে দেওয়া স্বত্ত্বেও তার কথা না শুনে লোকটা সেই ঘুমিয়েই পড়ল। দাঁড়কাক আর কি করে, মনের কষ্টে সে ফিরে গেল সেদিনের মত।


পরেরদিন লোকটা ঠিক করল তাকে যতই বলা হোক না কেন সে কিচ্ছুটি মুখে তুলবে না এমনকি এক ফোঁটা জল পর্যন্ত সে গ্রহন করবে না। কিন্তু বুড়ি তো নাছোড়বান্দা আর শেষপর্যন্ত বুড়ির এই জোড়াজুড়িতে হেরে গিয়ে লোকটা আগের দিনের মতই সেদিনও এক গ্লাস জল খেয়ে ফেলল। আর দুপুর দুটোর আগে বাগানের ভেতর চামড়ার স্তুপ এর ওপর অপেক্ষা করতে করতে আগের দিনের মতই গভীর ঘুমে চলে গেল। এমনিই রাজকন্যা দুঃখে ছিল গতদিনের কারনে, তার ওপর আজকেও এসে সে দেখল লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছে। খয়েরী রঙের ঘোড়াদের থেকে নেমে এসে সে লোকটাকে অনেক ডাকাডাকি করে তোলার চেষ্টা করল , কিন্তু সে এতটাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছিল যে কোন শব্দই তার কানে গিয়ে পৌঁছলোনা আর রাজকন্যেও মনের দুঃখে সেদিনের মত ফিরে গেল।



তৃতীয় দিন লোকটা মনে মনে ঠিক করল আজ যে করেই হোক রাজকন্যার কথা রাখতেই হবে আর আজ সে সত্যিই এক দানা খাবার তো দূর অস্ত, এক ফোঁটা জলও সে স্পর্শ করবেনা। তাই দেখে বুড়ি তাকে বলল, তুমি কি ভেবেছ? না খেয়ে মরে যাবে? লোকটা এই কথা শুনে বলল যে সে কথা দিয়েছে কাউকে তাই খাবার আর জল কিছুই গ্রহন করতে পারবেনা আর সে চায়ও না তার দেওয়া কথা থেকে সরে আসতে। কিন্তু কিছু পরেই বুড়ি একটা বড় থালায় করে কিছু ফল আর এক গ্লাস আঙ্গুরের রস তার সামনে আনতেই ফলের গন্ধে তার ভেতরটা আনচান করে উঠল আর নিজেকে সামলাতে না পেরে সে সমস্ত কিছুই আগের দিনের মত খেয়ে ফেলল। দুপুর দুটোর একটু আগেই সে বাগানের দিকে রওনা হল কিন্তু যেতে না যেতেই ঘুমে ডুবে গেল আর পাথরের মত নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল চামড়ার স্তুপের ওপর। সেদিনও দুটোর সময় রাজকন্যে এল চারটে কালো রঙের ঘোড়ায় টানা কালো রঙের গাড়ীতে করে চড়ে। গাড়ী ঘোড়া সব কিছুর রঙই কালো ; গত দুদিনের ঘটনায় রাজকন্যা এমনিতেই খুব দুঃখে ছিল তাই আসতে আসতেই সে মনে মনে ভাবছিল -লোকটা তাকে যে উদ্ধার করতে পারবে না এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়ে গেছে। সেদিনও রাজকন্যা দেখল লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছে যথারীতি। ঘোড়া থেকে নেমে রাজকন্যা তার পাশে একটা পাউরুটির টুকরো ,একটা মাংসের টুকরো আর এক বোতল আঙুরের রস রেখে দিয়ে মনে মনে জাদুবলে প্রার্থনা করল লোকটার যেন এ জিনিসগুলোর কোনদিনও অভাব না হয়। তারপর তার হাতের একটা সোনার আংটি খুলে লোকটার হাতে পড়িয়ে সেখানে রাজকন্যের নাম খোদাই করে দিল। বাগান থেকে ফিরে যাওয়ার আগে রাজকন্যে সাদা একটুকরো কাগজে একটা ছোট্ট চিঠি লিখে লোকটার পাশে দিয়ে গেল।চিঠিতে তাকে উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি এবং উদ্ধার করতে না পেরে লোকটার ঘুমিয়ে পড়া সবকিছুরই কথা রাজকন্যা লিখে দিল আর তার সাথে এও লিখলো যে লোকটা যদি এরপরও সত্যিই রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে চায় তাহলে সে যেন রত্নাগড়ের দূর্গে যায়, রাজকন্যাকে সেখানেই সে পাবে। চিঠিটা লোকটার পাশে রেখেই রাজকন্যা ঘোড়ার গাড়িতে উঠে রত্নাগড়ের দূর্গের দিকে রওনা হয়ে গেল।


আমার বর। তারপর ধুমধাম করে রাজকন্যার সাথে লোকটার বিয়ে দিলেন রানিমা আর তারপর থেকে তারা পরমসুখে আনন্দে দিন কাটাতে লাগল।



(জার্মানীর রূপকথা অবলম্বনে)

একটা ছোট্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে



 অনেক, অনেকদিন আগে, রাশিয়ার বিস্তীর্ণ স্তেপ অঞ্চলে একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল। সেই গ্রামের অধিবাসীদের ঘোড়া পালন করাই প্রায় সবার অন্যতম জীবিকা ছিল। প্রত্যেক বছরে অক্টোবর মাসে সদর শহরে গবাদি পশুর একটা বিরাট বাজার বসত। একবার কী হল, দুই ভাই, যাদের একজন পয়সাওলা আর একজন গরিব, তারা দুজনে মিলে সেই বাজারে গেল। পয়সাওলা ভাই গেল একটা ঘোড়ায় চড়ে, আর তার গরিব ভাই গেল একটা অল্পবয়সী ঘুড়ীর পিঠে চেপে।

একটা ছোট্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে


সন্ধের মুখে তারা একটা ফাঁকা কুঁড়েঘরের পাশে এসে থামল আর দুটো খড়ের গাদায় দুজনে শুতে যাওয়ার আগে তাদের ঘোড়াগুলোকে ঘরের বাইরেটায় বেঁধে রাখল। পরের দিন সকালে দুটোর জায়গায় তিনটে ঘোড়া দেখে তারা যারপরনাই অবাক হয়ে গেল। ও, ভালো কথা, নতুন যে এসেছে, সে কিন্তু একটা বড়ো ঘোড়া নয়। সেটা ওই ঘুড়ীটার বাচ্চা। রাত্তিরে ঘুড়ীটা ওকে জন্ম দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা পেল, আর একবার মায়ের দুধ খেয়েই, নড়বড় করতে করতে জীবনের প্রথম কয়েক পা হাঁটল। পুরুষ ঘোড়াটা একটা আনন্দের চিৎকার করে তাকে অভিনন্দন জানাল। ভাই দুজন যখন ঘুড়ীর বাচ্চাটাকে প্রথম দেখল, তখন সে ঘোড়াটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

'এটা আমার!' বাচ্চাটাকে দেখামাত্র বলে উঠল বড়োলোক দিমিত্রি। 'এটা আমার ঘোড়াটার বাচ্চা।' এই শুনে গরিব ইভান হাসতে লাগল।

'ঘোড়ার বাচ্চার কথা কে কবে শুনেছে? এটা আমার ঘুড়ীটার বাচ্চা।'

'না, মিথ্যে কথা! ও ঘোড়াটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, তাই ও ঘোড়াটারই বাচ্চা। আর তাই, এটা আমার।' দু-ভাইয়ে ঝগড়া করতে শুরু করল। তারা ঠিক করল যে তারা শহরে যাবে। সেখানে বিচারকদের কাছে গোটা ব্যাপারটা বলে বিচার চাইবে। তর্ক করতে করতেই তারা বিচারশালাটা যেখানে সেই বড়ো চত্বরটার দিকে পা বাড়াল। কিন্তু তারা যেকথাটা জানত না সেটা হল, সেই দিনটা ছিল একটা বিশেষ দিন। বছরে একবার ওই দিনটায় সম্রাট নিজে বিচার করতেন। যারা তাঁর কাছে বিচার চাইতে আসত সবাইকে তিনি নিজে অভ্যর্থনা জানাতেন। দু-ভাইকে তাঁর সামনে হাজির করা হলে তারা তাঁকে গোলমালটা সম্পর্কে সব কিছু বলল।

একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সম্রাট ভালো করেই বুঝেছিলেন ঘুড়ীর বাচ্চাটার আসল মালিক কে। তিনি যখন গরিব ইভানের পক্ষেই রায় দিতে যাবেন ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ ইভানের চোখটা নেচে উঠল। তুচ্ছ এক চাষির এ-রকম আচরণ দেখে সম্রাট তো গেলেন বেজায় খেপে। তক্ষুনি তিনি ঠিক করলেন এই বেয়াদপির জন্য ইভানকে শাস্তি দেবেন । দু-পক্ষের গল্পটা শোনার পর, তিনি বললেন, দেখো, ওই বাচ্চাটা যে ঠিক কার এটা বলা খুব শক্ত, এমনকী অসম্ভবও বলা যেতে পারে। সম্রাট ছিলেন আমোদপ্রিয়। তাই তিনি মাঝে মাঝেই তাঁর পারিষদদের নানারকম ধাঁধা বলে তার উত্তর বের করতে বলতেন। তিনি একটু মজা করার জন্য এই বলে চেঁচিয়ে উঠলেন,

'তোমাদের মধ্যে কার এই বাচ্চাটা পাওয়া উচিত সেকথা বলা শক্ত। তাই আমি তোমাদের চারটে ধাঁধা দিচ্ছি। তোমাদের মধ্যে যে এই চারটে ধাঁধার সঠিক উত্তর দিতে পারবে সে এই বাচ্চাটা পাবে।
ক) এই দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতগামী কী?
খ) এই দুনিয়ায় সবচেয়ে মোটা কী?
গ) এই দুনিয়ায় সবচেয়ে নরম কী?
আর ঘ) এই দুনিয়ায় সবচেয়ে দামি কী?
এক সপ্তাহের মধ্যে এই চারটে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসতে আমি তোমাদের আদেশ দিচ্ছি।'

বিচারশালা থেকে বেরোনোর সঙ্গেসঙ্গে দিমিত্রি ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা করতে শুরু করে দিল। যখন সে বাড়ি পৌঁছোল, সে বুঝতে পারল যে তাকে সাহায্য করার কেউ নেই। তার বৌ-এর অত বুদ্ধি নেই।

'দেখা যাক, আমাকে তো সাহায্য চাইতেই হবে, কারণ এই ধাঁধাগুলোর উত্তর বের করতে না পারলে তো আমি বাচ্চাটা পাব না!' এইসব ভাবতে ভাবতে তার এক পড়শি মহিলার কথা মনে পড়ল যাঁকে সে একটা রুপোর মুদ্রা ধার দিয়েছিল। সেও নয় নয় করে বেশ কিছুদিনই হয়ে গেল। সুদসমেত সেই একটা রুপোর মুদ্রা এখন তিনটেতে গিয়ে ঠেকেছে। আর যেহেতু তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতি বলে বেশ নাম আছে, কিন্তু বেশ চতুরও, তাই দিমিত্রি তার পরামর্শ নেবে ঠিক করল, বদলে তাঁর ঋণের একটা অংশ সে মকুব করে দেবে। কিন্তু সেই মহিলা, তাঁর বুদ্ধির ধার আসলে ঠিক কতটা তা দেখাতে মোটেও দেরি করলেন না। তিনি সঙ্গেসঙ্গে দাবি করলেন যে, ওই উত্তরগুলোর বদলে তাঁর পুরো ঋণটাই মকুব করে দিতে হবে।

'এই দুনিয়ার দ্রুততম জিনিস হল আমার স্বামীর লালচে-বাদামি ঘোড়াটা,' বললেন তিনি। 'কেউই তাকে হারাতে পারে না! আমাদের শুয়োরটা হল সবচেয়ে মোটা! ও-রকম একটা হোঁতকা জানোয়ার কেউ কখনো দেখেনি। আমার নিজের রাজহাঁসটার পালক দিয়ে আমি আমাদের বিছানার জন্য যে তোশকটা বানিয়েছি, সেটা সবচেয়ে নরম। আমার সব বন্ধু ওটা দেখে হিংসে করে। আর এই দুনিয়ার সবচেয়ে দামি হল আমার তিন মাসের ভাইপো। ওর চেয়ে সুন্দর বাচ্চা আর হয় না। পৃথিবীতে যত সোনা আছে তার পরিবর্তেও আমি ওকে দিয়ে দিতে পারব না। আর সেই কারণেই ও হল এই পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস।'

মহিলার উত্তরগুলো সম্পর্কে দিমিত্রি কিন্তু বেশ ধন্দে ছিল। এদিকে, তাকে তো কিছু একটা উত্তর নিয়ে সম্রাটের সামনে হাজির হতে হবে। তার মনে হল, এই উত্তরগুলো নিয়ে যেতে না পারলে সে শাস্তি পাবে। তার ভাবনাটা ঠিকই ছিল।

ইতিমধ্যে হয়েছে কী, বিপত্নীক ইভান ফিরে গেল তার ছোট্ট কুঁড়েতে যেখানে সে তার বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে থাকত। মাত্র সাত বছরের বাচ্চা মেয়েটা প্রায়ই একা একা থাকত আর তার ফলে সে তার বয়সের তুলনায় হয়ে উঠেছিল ভাবুক ও বেশ চালাক । গরিব ভাই তার দাদার মতোই বুঝতে পেরেছিল যে সে নিজে নিজে ওই ধাঁধাগুলোর উত্তর বের করতে পারবে না। তাই সে বাচ্চা মেয়েটার ওপর ভরসা করল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর বাচ্চা মেয়েটা তাকে জোরের সঙ্গে বলল,

'সম্রাটকে বলো, এই দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতগামী হল শীতের উত্তুরে হাওয়া। সবচেয়ে মোটা হল আমাদের জমির মাটি যার ফসল মানুষ আর পশু দুজনকেই জীবন দেয়। সবচেয়ে নরম হল একটা শিশুর স্নেহস্পর্শ আর সবচেয়ে দামি হল সততা।'

অবশেষে দুই ভাইয়ের সম্রাটের সামনে হাজির হওয়ার দিনটা এল। তাদের তাঁর সামনে হাজির করা হল। তারা কী বলবে সেটা শোনার জন্য সম্রাট উৎসুক হয়ে বসে ছিলেন। কিন্তু দিমিত্রির বোকা বোকা উত্তরগুলো শুনে তিনি হাসিতে ফেটে পড়লেন। যাই হোক, যখন ইভানের বলার পালা এল, সম্রাটের ভুরু কুঁচকে গেল। গরিব ভাইয়ের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর, বিশেষ করে সততা সম্পর্কে শেষেরটা শুনে তিনি ছটফট করে উঠলেন। সম্রাট ভালো করেই জানতেন যে, গরিব ভাইয়ের সঙ্গে তিনি অসৎ আচরণ করেছেন, কারণ তিনি তাকে ন্যায়বিচার দেননি। কিন্তু নিজের পারিষদদের সামনে তিনি সেকথা স্বীকার করতে পারলেন না আর তাই রেগেমেগে বললেন,

'কে তোকে এই উত্তরগুলো দিয়েছে?' ইভান তখন সম্রাটকে জানাল যে তার বাচ্চা মেয়েটা এই উত্তরগুলো দিয়েছে। তাতেও সম্রাটের রাগ যায় না। তিনি বললেন,

'এ-রকম বুদ্ধিমতী আর চালাক মেয়ের জন্য তোকে পুরস্কার দেওয়া হবে। তোর ভাই যে ঘুড়ীর বাচ্চাটা দাবি করেছিল সেটা তোকে পুরস্কার দেওয়া হবে, তার সঙ্গে এক-শোটা রুপোর মুদ্রাও দেওয়া হবে . . . কিন্তু . . .কিন্তু . . .' বলতে বলতে সম্রাট পারিষদদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন।

'সাতদিনের মধ্যে তুই তোর মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে আসবি। তবে যেহেতু ও খুব বুদ্ধি ধরে, ও আমার সামনে খালি গায়েও আসতে পারবে না আবার জামাকাপড় পরেও আসতে পারবে না, হেঁটেও আসতে পারবে না আবার ঘোড়ার পিঠে চড়েও আসতে পারবে না, আমার জন্য কোনো উপহার নিয়েও আসতে পারবে না আবার খালি হাতেও আসতে পারবে না। যদি ও এই শর্ত ঠিকঠাক মানতে পারে, তাহলে তুই তোর পুরস্কার পাবি। না হলে, হঠকারিতার জন্য তোর গর্দান নেওয়া হবে!'

যারা দর্শক ছিল তারা সবাই এই ভেবে হাসতে লাগল যে, গরিব ভাইটা কখনোই সম্রাটের শর্ত পূরণ করতে পারবে না। ইভান হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেল, তার চোখ জলে টস টস করতে লাগল। কিন্তু যখন সে তার মেয়েকে গোটা ব্যাপারটা বলল, তার মেয়ে শান্তভাবে বলল,

'কাল একটা বড়সড়ো খরগোশ আর একটা তিতির পাখি ধরে আনবে। দুটোই কিন্তু জ্যান্ত হওয়া চাই। তুমি তোমার ঘোড়ার বাচ্চা আর একশো রুপোর মুদ্রা পাবে! ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও!' ইভান মেয়ের কথামতোই কাজ করল। ওই দুটো প্রাণী যে কেন দরকার সে-সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু তার মেয়ের বুদ্ধির ওপর তার ভরসা ছিল।

নির্দিষ্ট দিনে রাজপ্রাসাদ সম্রাটের উপস্থিতিতে দর্শকে ভরে গেল। সবাই উন্মুখ হয়ে ইভান আর তার বাচ্চা মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে, বাচ্চা মেয়েটা এসে হাজির হল, মাছ ধরার জাল দিয়ে তার সারা শরীর মোড়া। সে এসেছে খরগোশের পিঠে চেপে, হাতে ধরা একটা তিতির পাখি। সে খালি গায়েও ছিল না, আবার তার গায়ে জামাও নেই, সে হেঁটেও আসেনি আবার ঘোড়ার পিঠে চেপেও নয়। রেগেমেগে সম্রাট তাকে বললেন, 'আমি বলেছিলাম উপহার নিয়েও আসা যাবে না আবার খালি হাতেও আসা যাবে না!' একথা শুনে বাচ্চা মেয়েটা তিতির পাখিটাকে বের করল। সম্রাট সেটাকে ধরার জন্য হাত বাড়ালেন, কিন্তু পাখিটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে শূন্যে উড়ে গেল। তৃতীয় শর্তটাও পূরণ হল। বাচ্চা মেয়েটা এত বুদ্ধি করে এ-রকম একটা পরীক্ষায় উৎরে গেল যে সম্রাট নিজের মুখে তার প্রশংসা না করে পারলেন না। তিনি মৃদু, নরম স্বরে বললেন,

'তোর বাবা কি সত্যিই খুব গরিব আর সে কি মরিয়া হয়ে ঘোড়ার বাচ্চাটা চায়?'
'ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ! আমরা সত্যিই খুব গরীব' বাচ্চা মেয়েটা উত্তর দিল। ' বাবা নদী থেকে যে খরগোশ আর গাছ থেকে যে মাছ ধরেন তাই খেয়েই আমরা বাঁচি!'

'আহা!' সম্রাট যেন জিতেই গেলেন। 'তার মানে তোকে যতটা চালাক মনে হয় তুই ততটা চালাক নোস। জলে খরগোশ আর গাছে মাছের কথা কে কবে শুনেছে!' একথার উত্তরে বাচ্চা মেয়েটা চটপট বলল,

'আর কে-ই বা কবে শুনেছে যে ঘোড়ার বাচ্চা হয়?' একথা শুনে সম্রাট এবং রাজসভার প্রত্যেকে হাসিতে ফেটে পড়ল। তক্ষুনি ইভানকে একশো রুপোর মুদ্রা আর ঘোড়ার বাচ্চাটা দিয়ে দেওয়া হল। এদিকে সম্রাটও নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানোর এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি সগর্বে ঘোষণা করলেন,

'কেবলমাত্র আমার রাজ্যেই এ-রকম একটা বুদ্ধিমতী মেয়ে জন্মাতে পারে!'


ছবিঃ ত্রিপর্ণা মাইতি

ভালুক রাজকুমার ও নিন্‌ফার গল্প

 (মেক্সিকোর রূপকথা)



সে অ-নে-ক দিন আগের কথা। এক ছিল কাঠুরে। সে ছিল খুব গরীব। বন থেক কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে সে তার দিন গুজরান করত। তার ছিল তিনটি মেয়ে। তার মধ্যে ছোটটি ছিল সব থেকে সুন্দরী।

একদিন কাঠুরে বনের মধ্যে এক বিশাল গাছ কাটছে। এমন সময়ে , হঠাৎ কোথা থেক এক বিশাল, ভয়ানক ভালুক তেড়ে এসে তার হাত মুচড়ে কুঠারটা কেড়ে নিল

"এটা আমার জঙ্গল। এখানে তোমাকে কাঠ কাটার অনুমতি কে দিল?" হুঙ্কার দিয়ে বলল ভালুক। "তুমি আমার কাঠ চুরি করেছ! এবার তোমাকে নিজের প্রাণ দিয়ে এর দাম দিতে হবে"।

"ভালুক মশাই, আমাকে ক্ষমা করুন", কেঁদে বলল কাঠুরে বেচারা, "আমি তো শুধু একটু কাঠ কাঠছিলাম- এগুলিকে বেচে আমার তিনটে ছোট ছোট মেয়েকে খাইয়ে পরিয়ে রাখি। আপনি যদি আমাকে মেরে ফেলেন, তাহলে তো ওরা না খেতে পেয়ে মারা যাবে"।

ভালুক খানিক ভাবল। তারপরে বলল- "তোমার বাঁচার একটাই মাত্র উপায় আছে। তোমার যে কোন একটি মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দাও"। কাঠুরে তো হতবাক! কি বলবে বা কি করবে ভেবেই পেল না। তারপরে যখন ভেবে দেখল যে সে মরে গেলে তার মেয়েগুলি আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে, তখন সে ভালুকের প্রস্তাব মেনে নিল।

দিনের শেষে কাঠুরে বাড়ি ফিরে এল। খেতে বসে তার তিন মেয়েকে বললে সব কথা।
কাঠুরের বড় মেয়ে বলল- " বাবা, ভালুককে বিয়ে করার থেকে মরে যাওয়া ভাল"।
মেজ মেয়ে বলল- " বাবা, আমারও একই কথা"।

বড় দুই মেয়ের কথা শুনে কাঠুরে মুষড়ে পড়ল। তখন তার ছোট মেয়ে নিন্‌ফা বলল- "বাবা, আমি ভালুককে বিয়ে করব"।

পরের দিন নিন্‌ফা আর তার বাবা জঙ্গলে গেল। সেখানে ভালুক তাদের জন্য অপেক্ষা করেছিল। সুন্দরী নিন্‌ফাকে দেখে ভালুকের বেশ পছন্দ হল।

নিন্‌ফা ভালুককে শর্ত দিল। সে বলল- "আমার মা আমাকে বলেছিলেন সব সময়ে ঈশ্বরের নির্দেশ মেনে চলতে। তাই আমি যদি আপনাকে বিয়ে করি, তাহলে পাদ্‌রির সামনে বিয়ে করব"।

ভালুক নিন্‌ফার কথায় রাজি হল। সে জানাল, পাদ্রীকে তাহলে জঙ্গলে আসতে হবে। কাঠুরে পড়িমড়ি করে ছুটল পাদ্রীর খোঁজে। অনেক খুঁজে একজন পাদ্রীকে নিয়েও এল। তিনি মন্ত্র পড়ে ভালুক আর নিন্‌ফার বিয়ে দিলেন।

বিয়ের পরে ভালুক নিন্‌ফাকে নিয়ে জঙ্গলের গভীরে নিজের গুহার দিকে রওনা দিল। কাঠুরে মন খারাপ করে পাদ্রীর সাথে ঘরের পথ ধরল।

যখন সন্ধ্যা নেমে এল, তখন গুহার ভেতরে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে জোরালো গলায় ভালুক এক মন্ত্র আওড়ালোঃ
বিরাট ভালুক, লোমশ ভালুক, ভালুক ভয়ঙ্কর-
বদলে হও রাজপুত্তুর- সাহসী, সুন্দর!

মন্ত্র পড়ার সাথে সাথে ভালুক বদলে হয়ে গেল এক সুন্দর রাজপুত্র। সে নিন্‌ফাকে বলল- "আমি এক অভিশপ্ত রাজকুমার; এক ডাইনির অভিশাপে আমি দিনে ভালুক হয়ে যাই, আর রাতে আবার মানুষ হয়ে যাই। তুমি এখানে নিজের মনের আনন্দে থাক, যা ইচ্ছা তাই কর। একটাই শর্ত- তুমি কাউকে বলতে পারবে না যে আমি একজন অভিশপ্ত রাজকুমার।"

পরের দিন রাজপুত্র ঘুম থেকে উঠে বলল-
রাজপুত্তুর- সাহসী, রাজপুত্তুর সুন্দর!
বদলে হও বিরাট ভালুক, লোমশ ,ভয়ঙ্কর !
মন্ত্র বলার মুহুর্তের মধ্যে রাজপুত্র বদলে আবার ভালুক হয়ে গেল।

বেশি কিছুদিন কেটে গেল। নিন্‌ফা ভালুকের সাথে আনন্দেই থাকে, কিন্তু তার বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে, বাবা আর দিদিদের দেখতে ইচ্ছা করে। শেষে সে একদিন সাহস সঞ্চয় করে রাজপুত্রের কাছে অনুমতি চাইল- "এই জঙ্গলে তোমার সাথে ছাড়া তো আর কারোর সাথেই কথা বলতে পারি না। আমার খুব ইচ্ছা করছে বাবা আর দিদিদের সাথে দেখা করতে। বাড়ি তো এমন কিছু দূরে নয়। আমি তাড়াতাড়ি যাব আর অন্ধকার হওয়ার আগেই ফিরে আসব।"

রাজপুত্র নিন্‌ফাকে যেতে দিতে চাইছিল না। কিন্তু নিন্‌ফা যখন খুব মনখারাপ করে কাঁদতে শুরু করল, তখন সে রাজি হল। কিন্তু সে নিন্‌ফাকে বার বার করে বলে দিল যেন কে কিছুতেই তার গোপন কথা কাউকে না বলে।

পরের দিন নিন্‌ফা ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠল। সে রাজপুত্রের দেওয়া ভাল জামাকাপড় পরে সুন্দর করে সেজে নিল। বাড়ি গিয়ে বাবা আর দিদিদের সাথে দেখা হতেই তাদের তো আনন্দের আর শেষ নেই।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তার ভাল জামা, আর সুন্দর গয়না দেখে তার দিদিদের খুব হিংসা হল। তারা তখন ছোট বোন কে দুঃখ দেওয়ার জন্য বলতে থাকল- "কি লজ্জা! তোর একটা ভালুকের সাথে বিয়ে হয়েছে।" আর ভালুকের সম্পর্কে আরো খারাপ খারাপ কথা বলতে থাকল।

দিদিদের মুখে ভালুকের সম্পর্কে মন্দ কথা অনেকবার শুনতে শুনতে নিন্‌ফার এক সময়ে খুব রাগ হল। রাগের মাথায় সে ভালুকের জীবনের গোপন অভিশাপের কথা দিদিদের কাছে বলে দিল। দিদিরা তো সেই কথা শুনে অবাক!

নিন্‌ফার বড় দিদি তখন এক বুদ্ধি দিল –" তুমি এক কাজ কর। আজ তারে ভালুককে অনেক ভাল ভাল খেতে দাও। প্রচুর খেয়ে ভালুক যখন গভীরভাবে ঘুমাবে, তখন ওর হাত আর মুখ বেঁধে দাও। সকালে ঘুম ভাঙলে ভালুক আর চেহারা বদলানোর মন্ত্র বলতে পারবে না। তাহলেই ওই মন্ত্রের জাদু নষ্ট হয়ে যাবে। তখন তোমার বর আর কোনদিনই ভালুক হবে না

নিন্‌ফা সন্ধ্যেবেলা ভালুকের গুহায় ফিরে এসে দিদির কথামত ভালুককে ভালমন্দ খেতে দিল। পরের দিন সকাল বেলা ঘুম ভেঙে উঠে ভালুক তো অবাক হয়ে গেল তার নিজের হাত-মুখ বাঁধা দেখে।

তার ইশারায় নিন্‌ফা তার মুখের এবং হাতের বাঁধন খুলে দিল। তখন রাজপুত্র তাকে করুণ স্বরে বলল- "তুমি তোমার শপথ ভেঙে ফেলেছ নিন্‌ফা; এখন তোমাকে এর ফল ভোগ করতেই হবে; এই অভিশাপ থেকে আমি মুক্ত হতে পারতাম যদি তোমার সাথে এক বছর এক দিন থাকতে পারতাম। কিন্তু তুমি তো সেটা হতে দিলে না। আমি এখন চলে যাচ্ছি। তোমাকে এবার আমাকে খুঁজে নিতে হবে। আর তার জন্য তোমাকে আগে খুঁজে বার করতে হবে ‘বিশ্বাসের প্রাসাদ’।"

এই বলেই রাজপুত্র অদৃশ্য হয়ে গেল। নিন্‌ফা একা একা বসে অনেক্ষণ কাঁদল। তারপরে সে ঠিক করল সে তার স্বামীকে খুঁজে আনতে বিশ্বাসের প্রাসাদে যাবে।

নিজের সামান্য কিছু জিনিষ একটা পুঁটুলিতে বেঁধে নিনফা বিশ্বাসের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। মাঠ-ঘাট-বন-জঙ্গল পেরিয়ে অনেক , অনেক দূর হেঁটে চলল সে।

এক সময়ে নিন্‌ফা গিয়ে পৌঁছাল এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে তার দেখা হল এক বুড়ো জাদুকরের সাথে। বুড়ো তাকে জিজ্ঞাসা করল –" কন্যে, তুমি এই গভীর জঙ্গলে কি করছ?"
-"আমি বিশ্বাসের প্রাসাদ খুঁজছি। আপনি জানেন, সেটা কোন দিকে?"
"আমি জানি না বিশ্বাসের প্রাসাদ কোথায় রয়েছে। তবে কিনা চাঁদ ঠাকরুণ বলতে পারেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে পার। তবে তিনি কিন্তু বড্ড রাগী, তাই খুব সাবধান। আর এই তিনটে বাদাম সাথে রাখ। যদি কোন বিপদে পড় তাহলে একটা করে বাদাম ভেঙে ফেল।তোমার উপকার হবে।"

বুড়োর সাথে কথা বলার পর নিন্‌ফা আবার চলতে শুরু করল। পথ চলে চলে ক্লান্ত মেয়েটা শেষে অবধি গভীর রাতে চাঁদ ঠাকরুণের বাড়ির সামনে পৌঁছাল। সে দরজায় ঠুকঠুক করে কড়া নাড়ল। এক বুড়ি এসে দরজা খুলে দিল। সে ছিল চাঁদ ঠাকরুণের রাঁধুনী।
"আহারে দুঃখিনী বাছা! তুমি এখানে কি করছ?" জিজ্ঞেস করল বুড়ি। " তোমাকে দেখতে পেলে তো রাগী চাঁদ ঠাকরুণ তোমার ঘাড় মটাকাবে!" নিন্‌ফা তাকে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিজের দুঃখের কথা সব খুলে বলল।


বুড়ি নিন্‌ফাকে বলল- "তুমি চুল্লির পেছনে গিয়ে লুকাও। চাঁদ ঠাকরুণ এলে আমি জিজ্ঞাসা করে দেখব উনি বিশ্বাসের প্রাসাদ সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা।

উষাকালে কাজকম্মো সেরে চাঁদ ঠাকরুণ বাড়ি ফিরলেন। তাঁর মেজাজ তখন খুব গরম; আঙুলে বুনোফলের কাঁটা ফুটে গিয়েছে যে! রান্নাঘরে ঢুকেই চাঁদ ঠাকরুণ নাক-মুখ কুঁচকে বললেন- মানুষের গন্ধ যেন পাচ্ছি মনে হচ্ছে! এক্ষুনি মানুষটাকে ধরে এনে আমাকে দিবি, নাকি তোকেই ধরে খাব?"
সে কথা শুনে রাধুনী বুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বলল- "আ মোলো যা! তোমার মাথা খারাপ হয়েছে ঠাকরুণ" চুল্লীতে মুরগি সেঁকতে দিয়েছি, আর তোমার মনে হচ্ছে মানুষের মাংস?? বসে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমাতে যাও দিকি। তুমি কাজ করে ক্লান্ত, তোমার মাথার ঠিক নেই।"

চাঁদ ঠাকরুণ তো গুছিয়ে খেতে বসলেন। ওদিকে রাঁধুনী বুড়ি বকবক শুরু করলে – "আগের দিন প্যাঁচা এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল, তা আমি ওর সাথে একটু গল্পগুজব করলাম আর কি...তা প্যাঁচা বলছিল সে নাকি কোন এক বিশ্বাসের প্রাসাদ এর কথা শুনেছে। তা আমি তাকে বললুম- আমাদের চাঁদ ঠাকরুণ কত কিছু জানেন, তিনি নিশ্চয় ওই প্রাসাদের কথাও জানেন।"
খেয়ে দেয়ে চাঁদ ঠাকরুণের মেজাজ একটু ঠাণ্ডা হয়েছে। তিনি বুড়িকে বললেন- "সত্যি বলতে কি, এটা আমি জানিনা । তবে কিনা সুয্যি মশাই জানতে পারেন।"

এই বলে চাঁদ ঠাকরুণ তো ঘুমাতে গেলেন। রাঁধুনী বুড়ি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে নিন্‌ফাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে বলল- তাড়াতাড়ি হাঁটা লাগাও। চাঁদবুড়ি জেগে গেলেই মুশকিল! ওই সামনের পথ দিয়ে হাঁটো। সু্য্যি মশাই-এর বাড়ি পেয়ে যাবে।

নিনফা আবার হাঁটা শুরু করল, আর অনেক পথ হেঁটে শেষে সূয্যি মশাই- এর বাড়ির পৌঁছাল। তার কড়া নাড়া শুনে দরজা খুলে দিল এক ছোট্টখাট্টো বুড়ি।
"হা ভগবান, সুন্দরী কন্যে!" সে অবাক হয়ে বলল- "তুমি এখানে কি করছ? তুমি কি জাননা সূয্যিমশাই তোমাকে এখানে দেখলে রেগে গিয়ে তোমাকে ঝলসে দিতে পারেন?"
বেচারি নিন্‌ফা কেঁদে কেঁদে বুড়িকে তার দুঃখের কথা সব জানাল। তার করুণ কাহিনী শুনে তো বুড়িও দুঃখিত হয়ে পড়ল। তাদের কথার মাঝেই ঘর ভরে গেল তীব্র আলোয়, আর সূয্যিমশাই সারাদিনের কাজ সেরে বাড়ি ফিরলেন। নিন্‌ফা বুঝল এইবার তাকে মরতে হবেই। সে ভয়ে চোখ বুজে ফেলল।

"আরে, আরে কত্তামশাই, করেন কি? থামুন থামুন! "চেঁচিয়ে উঠল বুড়ি ।" এই দুঃখিনী মেয়েটি বিশ্বাসের প্রাসাদ খুঁজছে..."
"ওহঃ তুমিই তাহলে বিশ্বাসের প্রাসাদ খুঁজতে এসেছ?" সূয্যিমশাই অবাক হয়ে বললেন
চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিন্‌ফা তার সাথে ঘটে যাওয়া সব দুর্ঘটনার কথা জানাল।
"হুম,আমি জানি সেই বিশ্বাসের প্রাসাদ ঠিক কোথায় আছেল কিন্তু দেখ, সন্ধ্যা হয়ে গেল, এখন তো আমার বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু হ্যাঁ, একটা উপায় আছে ! আমার খুব ভাল বন্ধু হলেন বাতাস বাবুমশাই। তিনি তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারেন। তুমি এক কাজ কর- এই পথ ধরে হেঁটে যাও, তাহলেই পৌঁছে যাবে বাতাস বাবুমশাই-এর বাড়ি; ওনাকে গিয়ে বল আমি তোমাকে পাঠিয়েছি"।

আবার হেঁটে চলল নিন্‌ফা; আবারো অনেক পথ পেরিয়ে সে পৌঁছাল বাতাস বাবুমশাই-এর দরজায়; ঠুকঠুক করে দরজায় টোকা দিল সে। ভেতর থেকে ভেসে এক শনশন করে উত্তর –" কে এসেছ বাইরে, ভেতরে চলে এস"
নিন্‌ফা ভেতরে ঢুকে বাতাস বাবুমশাইকে বলল তাকে পাঠিয়েছেন সূয্যিমশাই, একটা অনুরোধ নিয়ে।
"রাখব তোমার অনুরোধ" বললেন বাতাস বাবুমশাই, "সে যা-ই হোক না কেন"
নিন্‌ফা তখন বাতাস বাবুমশাইকে তার সব দুঃখের কথা প্রথম থেকে খুলে বলল।
"কোন চিন্তা কর না, আমি নিজে তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব," বললেন বাতাস বাবুমশাই।


বাতাস বাবুমশাই-এর পিঠে চেপে বসল নিন্‌ফা, আর এক লহমায় পৌঁছে গেল এক বিরাট প্রাসাদের সামনে।
"এই হল বিশ্বাসের প্রাসাদ," বললেন বাতাস বাবুমশাই, "দেখেশুনে মনে হচ্ছে ভেতরে কোন বড় উৎসব হচ্ছে!"
পুরো প্রাসাদটা দারুণ সুন্দর করে আলোয় সাজানো ছিল; ভেতর থেকে ভেসে আসছিল মিষ্টি বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ।
"আমাকে এবার যেতে হবে," বললেন বাতাস বাবুমশাই, " ভয় পেওনা, তুমি তোমার কাজে ঠিক সফল হবে"

নিন্‌ফা প্রাসাদের দরজার কড়া নাড়ল, আর এক কর্মচারী বেরিয়ে এল।
" আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?" জিজ্ঞাসা করল কর্মচারী।
"আমি রাজপুত্রের সাথে দেখা করতে চাই," জানাল নিন্‌ফা।
"মহাশয়া," কর্মচারীটি বলল, "আপনি তো তাঁর সাথে এখন দেখা করতে পারবেন না। তাঁর আজ বিয়ে হচ্ছে কিনা, আর তিনি এখন রাজকন্যার সাথে বাজনার তালে তালে নৃত্য করছেন।"
একথা শুনে নিন্‌ফা বলল, "তাহলে আমাকে অন্তত এই আনন্দ অনুষ্ঠান দেখার একটা সুযোগ করে দিন দয়া করে। আমি এইরকম বড় অনুষ্ঠান আগে কোনদিন দেখিনি"।
নিন্‌ফার আবদার শুনে কর্মচারী অনেক ভেবে বলল- "ঠিক আছে, আমি আপনাকে ভেতরে ঢুকতে দিতে পারি, কিন্তু খেয়াল রাখবেন, বিয়ের কনে রাজকন্যা যেন আপনাকে দেখে না ফেলেন; দেখেল কিন্তু খুব রেগে যাবেন, আপনি নিমন্ত্রিত নন কিনা..."

নিন্‌ফা ভেতরে ঢুকে দেখে তার স্বামী সেই রাজপুত্র, টেবিলে বসে অনেক অতিথিদের সাথে খাওয়াদাওয়া করছে।
সে নিজে দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাজপুত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকল। কিন্তু রাজপুত্র তো অন্যদের সাথে গল্প করে যাচ্ছে। সে বেচারি নিন্‌ফাকে দেখতেই পেল না।
এদিকে এক সময়ে নিন্‌ফাকে দেখে ফেলল সেই বিয়ের কনে। সে আসলে ছিল এক দুষ্টু ডাইনি, যে নিজের জাদুর জালে জড়িয়ে রাজপুত্রকে বন্দী করে বিয়ে করছিল।


এই সময়ে রাজপুত্রও নিন্‌ফাকে দেখতে পেল। সে সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রীকে চিনতে পারল। সে কর্মচারীদের হাঁক দিয়ে ডেকে বলল নিন্‌ফাকে তার কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু হই-হট্টগোলের মধ্যে কেউ তার কথা শুনতেই পেল না।
ওদিকে দুষ্টু রাজকন্যা তার রক্ষীদের ডেকে বলল – "শিগ্‌গির তোমরা ওই ভিখারিনী মেয়েটাকে ধরে বার করে দাও"

রক্ষীরা নিন্‌ফাকে সেই ধরতে গেল, সে তক্ষুণি সেই বুড়ো যাদুকরের দেওয়া একটা জাদু বাদাম ভেঙে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে সে এক ছোট্ট ইঁদুর হয়ে এদিক ওদিক ছুটতে লাগল। সেই দেখে ডাইনি এক বিরাট কালো বিড়াল হয়ে ইঁদুরকে তাড়া করল।

ইঁদুর তখন এক লাফে টেবিলে উঠে রাজপুত্রের থালায় গিয়ে পড়ল। তখন ইঁদুর রূপী নিন্‌ফা আরেকটা বাদাম ভেঙে ফেলল। সে সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল ভাতের একটা কণা। রাজপুত্রের থালায় ছড়ানো অনেক ভাতের মধ্যে সে মিশে গেল। বিড়াল বেশী ডাইনী তখুনি টেবিলে উঠে পড়ে নিজেকে মুরগিতে বদলে নিল, আর কপকপ করে ভাত খেতে লাগল।

নিন্‌ফা তখন বুড়ো জাদুকরের দেওয়া তৃতীয় জাদু বাদামটি ভেঙে ফেলল, আর নিজেকে কয়োটির রূপ দিল। সেই কয়োটি তখন মুরগিকে ধরে খেয়ে ফেলল।

ডাইনী রাজকন্যাকে শায়েস্তা করার পরে নিন্‌ফা আবার মানুষের চেহারায় ফিরে এল। এর পরে সে রাজপুত্রের সাথে সুখে ঘরকন্না করতে থাকল।


ছবিঃআত্রেয়ী দত্ত